বেগম রোকেয়া রচনা

আজ আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করবো মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের বাংলা দ্বিতীয় পত্রের বেগম রোকেয়া রচনা নিয়ে। আপনাদের সামনে বেগম রোকেয়া রচনাটি এমন ভাবে উপস্থাপন করেছি যে আপনারা তা মুখস্থ বা ধারনা নিয়ে রচনা পরিক্ষায় লিখে ভালো মার্ক ক্যারি করতে পারবেন। 

ভূমিকা

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন একজন নারী জাগরণের অগ্রদূত। তিনি নারী শিক্ষা ও নারীর অধিকার নিয়ে অনেক সমাজ সচেতন ও সংস্কার মুক্ত ও দূর দৃষ্টি সম্পন্ন সম্পর্কে আন্দোলন করতেন।  এই মহীয়সী নারী রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে ১৮৮০ সালের ০৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যে সময়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। 

বেগম রোকেয়া রচনা

তখন বাঙালি মুসলমান সমাজ, নারী সমাজ শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল। পর্দা প্রথার শাসনের ফলে নারীসমাজ ছিলো অবরোধবাসিনী বা গ্রহ বাধা। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ফলে নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণ অগ্রযাত্রা শুরু হয়। রকের সাখাওয়াত হোসেন অনেক লেখালেখি করেন। তিনি এক মাত্র বাঙালি মুসলিম নারী যে নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং প্রথম বাঙালি নারীবাদী প্রথা নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন। 

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন কঠের পরিশ্রম ফলে মুসলিম পিছিয়ে পড়া নারী সমাজের যে কুসংস্কার প্রথা  ছিল তার থেকে বের করে আনেন। এবং আলোয় আলকিত করতে এই মহীয়সী নারী নিজের জীবন কে নিবেদিত করেছিলেন। ফলে বর্তমানে নারী রা আজ শিক্ষাদীক্ষায়, কর্মক্ষেত্রে ও সব খানেই প্রতিষ্টিত হতে পেরেছে। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এই মহীয়সী নারী ১৯৩২ সালের ৯ই ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যু বরণ করেন।

রোকেয়া পরিবার ও সমাজ

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন পারিবারিক নাম হল রোকেয়া খাতুন। এবং তার স্বামীর নামের শেষ অংশ সাখাওয়াত হোসেন নিয়ে পরিচিত হন। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের পিতার নাম হল জহির উদ্দিন মুহ্মমদ আবু আলী সাবের। সাখাওয়াত হোসেনের পিতা জহির উদ্দিন মুহ্মমদ আবু আলী একজন জমদার ছিলেন। এবং এই মহীয়সী নারীর মাতার নাম ছিল রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন দুই বোন ছিলেন তাদের নাম হল করিমুন্নেসা ও হুমায়রা। এছাড়াও এই মহীয়সী নারীর বড় দুই ভাই ছিল মুহাম্মদ ইব্রাহিম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান সাবের। সে সময়কার বাঙালি সমাজের প্রথা ছিল ০৫ বছর হলে নারীদের পর্দা করতে হতো এবং শৈশবকালে কঠোর নিয়ম অনুসারে আতিবাহিত করতে হত। 

আরোও দেখুন>

সে সময় আরবি-ফারসি ও উর্দু শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের পিতা বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষার বিরোধী ছিলেন। এছাড়াও তখনকার দিনে সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের ঘরের বাইরে গিয়ে শিক্ষার কোন সুজুগ ছিল না। কিন্তু এই মহীয়সী নারীর পড়ালেখার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যখন কলকাতায় তার মাতার সঙ্গে থাকতেন তখন তিনি এক ইংরেজ মেয়ের কাছে শিক্ষা লাভ করেন। 

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ভাই-বোনের এই বিদ্যানুরাগ থেকে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইংরেজি শেখান। বেগম রোকেয়া পিতার কঠোর নজরদারি থেকে এড়িয়ে দুই ভাই-বোনের সহযোগিতায় বাংলা ইংরেজি শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এছাড়াও বেগম রোকেয়ার বোন করিমুন্নেসা কাছ থেকে অনুপ্রেরণা বাংলা সাহিত্য রচনার ও চর্চার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফলে এই মহীয়সী নারী একই সঙ্গে বাংলা, ইংরেজী, উর্দু, ফারসি ও আরবি ভাষা আয়ত্ব করেন। 

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বৈবাহিক জীবন

রোকেয়া ১৮৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুর নিবাসী ও উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বেগম রোকেয়া স্বামী ছিলেন একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি ছিলেন তদুপরি সমাজসচেতন, কুসংস্কার মুক্ত ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন ব্যক্তি। এই মহীয়সী নারীর শৈশবকাল কষ্টের মাধ্যমে কাটলেও তার বিবাহিত জীবনে তিনি অনেক সুখী ছিলেন। কারণ এই মহীয়সী নারী তার স্বামীর অনুপ্রেরণায় জ্ঞানচর্চার পরিধি বিস্তৃত করতে পেরেছিলেন।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্বামীর উদার মনের ও আধুনিক মুক্ত মনের অধিকারী হওয়ার ফলে দেশী-বিদেশী লেখকদের রচনা সঙ্গে নিবিড় ভাবে পরিচিত হওয়ার সুজুগ পান ও সেই সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন লাভ করেন। এই মহীয়সী নারী তার স্বামীর অনুপ্রেরণায় সাহিত্য-চর্চা ও লেখা-লেখিতে সূত্রপাত ঘটেছিল। 

কিন্তু তার এই আশীর্বাদ বেশি দিন ভাগ্যে জোটেনি ১৯০৩ সালে তিনি স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যু হলে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। স্বামীর মৃত্যুর পর পরই এই মহীয়সী নারীর দুটি কন্যা সন্তান অকালে মৃত্যুবরণ করেন, ফলে তিনি আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। 

নারী শিক্ষা বিস্তার

বেগম সাখাওয়াত হোসেন এই মহীয়সী নারীর বাংলায় শিক্ষার জন্য তার দুই ভাই-বোন মুসলমান সমাজে জন্য অবদান রাখেন। ১৯০৩ সালে স্বামীর মৃত্যুবরণ করার পর ভাগলপুরে এই মহিয়সী নারী তার স্বামীর স্মরণে ০৫ জন ছাত্রী নিয়ে একটি মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠিত করেন। এই স্কুল থেকে নারী শিক্ষা বিস্তারের কার্যক্রম তিনি শুরু করেন। 

১৯১১ সালে কলকাতায় স্কুলটি স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই মহীয়সী নারী মুসলমান নারীদের সামনে আধুনিক শিক্ষার দরজা খুলে দেন। এর ফলে স্কুলটিতে ধীরে ধীরে মুসলিম ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে ১৯১৭ সালে স্কুলটি ইংরেজি স্কুলে পরিণত হয়। ফলে বাংলার পাশা-পাশি ইংরেজি শিক্ষা প্রদান করা হয়। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন শুধু মুসলিম নারীদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন নি। তিনি চেয়েছিলেন প্রতিটি ঘরের মেয়েই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। 

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রতিটি ঘরে গিয়েই মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য অভিভাবকদের কাছে অনুরোধ করেছিলেন। এবং মেয়েদের স্কুলে যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়াও এই মহীয়সী নারী আন্তরিক প্রচেষ্টায় ফলে ১৯২৯ সালে কলকাতায় মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সাহিত্যের অবদান

এই মহীয়সী নারী শুধু নারীদের অধিকার ছাড়াও বাংলা সাহিত্যে অবদান রাখেন। ১৯০২ সালে কলকাতার নবপ্রভা পত্রিকায় পিপাসা নামক রচনা প্রকাশ করেন। এই রচনাটি প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে আনুষ্ঠানিক ভাবে পদার্পণ করেন। এরপর এই মহিষী নারী নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী প্রতি সমসাময়িক পত্রিকায় তিনি নিয়মিত রচনা লিখতে থাকেন। 

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর লেখনি তৎকালীন মুসলিম সমাজকে দারুণ ভাবে নাড়া দিয়েছিল। ফলে রক্ষণশীল সমাজ তার যুক্তি পূর্ণ বক্তব্যকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেনি তাই তার অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। 

সাখাওয়াত হোসেন তাঁর লেখার মাধ্যমে নারী মুক্তির কথা উল্লেখ করেন এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ত্রুটি গুলো নির্দেশ করেন। একই ভাবে মানসিক দাসত্বের কথা সমালোচনা করেছিলেন। এছাড়াও বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারীর অলংকার কে দাসত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত করেছিলেন। এই মহীয়সী নারীর নারীবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটেছিল মতিচুর প্রথম খন্ড ও দ্বিতীয় খন্ডে। 

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের রচনাবলী

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের sultana’s ড্রিম নামে একটি ইংরেজি রচনা ছিল। যা পরবর্তী কালে সুলতানার স্বপ্ন(১৯০৮) নামে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটির মাধ্যমে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যের অন্যতম একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত করা হয়।  

এছাড়াও বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের অন্য রচনা মতিচুর(১৯০৪)  প্রাকাশিত হয়। এবং অন্য রচনা দুটি হল অনুরাগ(১৯২৪) ও অবরোধ বাসিনী(১৯৩১) উল্লেখযোগ্য রচনা। এই মহীয়সী নারী, নারী শিক্ষার কথা প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাসের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। তার সকল রচনাই ছিল নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজ সংস্কারের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত। 

নারী জাগরণের অগ্রদূত

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন একজন দূর দৃষ্টি সম্পন্ন, সচেতনতা মূলক, সংস্কারমুক্ত প্রগতিশীল ও সমাজকর্মী ব্যক্তি। এই মহীয়সী নারী মনে করতেন শুধু লিখতে বা পড়তে পারলেই নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য নয়। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হল নারীকে তার অধিকার লাভের সক্ষম করে তোলা এবং প্রাকৃত শিক্ষার মাধ্যমে একজন নারীকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। 

নারী জাতি পুরুষের দাসত্বে জীবন না কাটায় সে বিষয়ে তিনি নারীদের সচেতন করতে সামাজিক আন্দোলন চালিয়ে যান। এর ফলশ্রুতিতে ১৯১৬ সালে আঞ্জুমান খাওয়াতিনে ইসলাম বা মুসলিম নারীদের সমতি গড়ে তোলেন। এছাড়াও মুসলিম ও অমুসলিম নারীদের জন্য অসংখ্য নারী সমিতি গড়ে তোলেন। 

নারীর উন্নয়নে দেশবাসীকে উৎসাহ প্রদান করেন। এছাড়াও তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ক্ষুরধার লেখনী ধারণ করেন। নারীর অধিকার নিশ্চিত করার জন্য পুরুষের বহুবিবাহ, নারীদের বাল্যবিবাহ ও পুরুষের একতরফা তালাক প্রথার বিরুদ্ধে লেখনীর মাধ্যমে আন্দোলন শুরু করেন। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন পাশ করেন। 

উপসংহার 

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী ও সমাজের কল্যাণ সাধনের জন্য অবনী স্বীকার্য অবদান রাখেন। এছাড়াও সমাজ-সভ্যতার অগ্রসরতার পিছনে নারী ও পুরুষ উভয়ের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু নারীর পেছনে সমাজের সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব নয় তা এই মহিষী নারী গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। 

যার ফলে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী ও পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রাম চালিয়ে যান এবং তা সফল হন। বর্তমানে নারীদের কর্মক্ষেত্র ও মুক্ত করার পিছনে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন অবদান অনিসিকার্য ছিল। 

আমাদের এই আর্টিকেল পড়ার মাধ্যমে আপনারা বেগম সাখাওয়াত হোসেন রচনাটি সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। আর্টিকেল টি যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে সামাজিক মাধ্যম গুলোর মাধ্যমে অন্যদের দেখার সুযোগ করে দিতে পারেন। এছাড়াও নিত্য নতুন শিক্ষামূলক আর্টিকেল পেতে আমাদের ওয়েবসাইটটি সেভ অথবা বুকমার্ক করে রাখতে পারেন ধন্যবাদ। 

Leave a Comment